— এক নারীর সাহস, পরিশ্রম ও অর্থনৈতিক মুক্তির অনন্য গল্প
হেলাল হোসেন কবির, লালমনিরহাট।
লালমনিরহাট পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে নীরবে কাজ করে চলেছে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, যার নাম মুক্তি মজুমদারের ‘শুভেচ্ছা প্যাকেট বিতান’। এই কেন্দ্রটি শুধু প্যাকেট তৈরি করে না, এটি গড়ে তুলেছে বেশ কিছু অসহায় নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার প্ল্যাটফর্ম। চিত্ত রঞ্জন মজুমদারের স্ত্রী মুক্তি মজুমদার শহরের গার্ড পাড়ায় নিজ বাড়িতে এই উদ্যোগটি পরিচালনা করছেন।

🛠️ উদ্যোক্তার হাত ধরে কর্মসংস্থান
মুক্তির এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন প্রায় ৯ থেকে ১০ জন মহিলা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধরা, একসঙ্গে কাজ করেন। প্রতি মাসে তাঁরা গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার প্যাকেট উৎপাদন ও বিক্রি করেন।
’শুভেচ্ছা প্যাকেট বিতান’ শুধুমাত্র নামেই নয়, এটি বিভিন্ন মিষ্টির দোকান, বেকারি ও রেস্তোরাঁর জন্য উচ্চমানের প্যাকেট ও কার্টন উৎপাদন করে থাকে। স্থানীয় বাজার ছাড়াও পাইকারি বিক্রেতা এবং ইভেন্ট আয়োজকদের কাছেও তাদের পণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিশেষত, লালমনিরহাট, আদিতমারী এবং পাশ্ববর্তী জেলা কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার প্রায় ২৫টি হোটেলের নামে কাস্টমাইজড প্যাকেট সরবরাহ করেন তাঁরা।
সকল খরচ মিটিয়ে এই উদ্যোগের মাসিক আয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে (করোনার পরে) তা কিছুটা কমে ২০ হাজার টাকা হয়েছে। এই আয় পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ও জরুরি খরচ যোগাতে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

💪 প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে থাকার লড়াই
মুক্তি মজুমদারের ব্যক্তিগত জীবনও সংগ্রামের কাহিনি। ১৯৮২ সালে যখন তাঁর বিয়ে হয়, তখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। মা মারা যাওয়া এবং বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কারণে তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সামান্য বেতনের রেলওয়ে কর্মচারী স্বামীর আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।
বসে না থেকে, তিনি প্রথমে ছোট বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করেন। পাশাপাশি হাতের নকশার কাজ ও সেলাই মেশিন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিন সন্তানের জননী হওয়ার পর (ছোট মেয়ের জন্ম ২০০২ সালে), সংসারের আর্থিক যোগান নিশ্চিত করতে আরও কিছু করার প্রেরণা খুঁজতে থাকেন।

💡 খালার পরামর্শে স্বপ্নের শুরু
নিজের অসহায়ত্ব ও তিন সন্তানকে মানুষ করার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে তিনি এক খালার মিষ্টির দোকানের পরামর্শ গ্রহণ করেন। খালাই তাঁকে আধুনিক খাবারের প্যাকেট তৈরির ধারণা দেন এবং অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেন। গাইবান্ধার বোনার পাড়া থেকে তিনি এই কৌশল শিখে আসেন।
তবে শুরুতেই প্রতারণার শিকার হন। রংপুরের প্রেসে কাগজ কাটতে দিলে এক কর্মচারী তা নিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু দমে না গিয়ে তিনি বগুড়া থেকে কাজ শুরু করেন এবং বর্তমানে বাড়ি কিনে নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন। নিজে পড়াশোনা করতে না পারলেও, সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তার ছোট মেয়ে পড়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।
🤝 নারী নেত্রীর চোখে মুক্তির গল্প
এ বিষয়ে নারী নেত্রী ও লালমনিরহাট সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাড. আঞ্জুমান আরা শাপলা বলেন, “মুক্তি মজুমদারের ‘শুভেচ্ছা প্যাকেট বিতান’-এর আড়ালে রয়েছে সাহস, সহযোগিতা আর পরিশ্রম মিলিয়ে সৃষ্টি হওয়া নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির এক অনন্য গল্প। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা, যাঁর উদ্যোগ পরিবার এবং কর্মসংস্থান পাওয়া অন্যান্য মহিলাদের দৈনন্দিন খরচ ও জরুরি চাহিদা মেটাতে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখছে।”
মুক্তি মজুমদারের এই প্রচেষ্টা প্রমাণ করে, সঠিক সহযোগিতা এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো প্রতিকূলতা পেরিয়ে নারীও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে পারে।
(প্রতিবেদক: হেলাল হোসেন কবির, লালমনিরহাট। যোগাযোগ: ০১৭৭৭১৬৯০১১)